ঢাকা , বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ , ২৩ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
সংবাদ শিরোনাম
হেরা ফেরি ৩-তে ফিরছেন টাবু বাশার-তিশার নতুন রোমান্সের গল্প ‘বসন্ত বৌরি’ ওজন কমাতে সার্জারি, প্রাণ গেল মেক্সিকান ইনফ্লুয়েন্সারের ‘স্কুইড গেম’ অভিনেত্রী লি জু-শিল আর নেই বিচ্ছেদের পর ফের নতুন প্রেম খুঁজছেন মালাইকা অরোরা? দেশের প্রেক্ষাগৃহে ‘বলী’ আসছে ৭ ফেব্রুয়ারি হামলার পর প্রথমবার জনসমক্ষে সাইফ আলী খান অবশেষে প্রকাশ্যে এলো চিত্রনায়িকা পপির স্বামী-সন্তানসহ ছবি সমালোচনা সহ্য না হলে উপদেষ্টা পদ ছেড়ে রাজনৈতিক দল করেন-রিজভী লালমনিরহাটে বিয়ে করে ফেরার পথে বরের মৃত্যু পুঁজি রক্ষার আন্দোলনে বিনিয়োগকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কমাতে, একীভূতকরণে নজর দেয়ার সুপারিশ বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে আরও কমার আশঙ্কা বান্দরবান সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে কিশোরের পা বিচ্ছিন্ন ট্রেনের ধাক্কায় ট্রাকের চালক সহকারী নিহত জগন্নাথ হলে সরস্বতী পূজামণ্ডপ পরিদর্শনে দুই উপদেষ্টা রমজান মাসে গ্যাস বিদ্যুতের বড় সংকটের শঙ্কা বাংলাদেশকে সহায়তা করছে ব্রিটিশ সংস্থা তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের ধৈর্য ধরতে হবে-নাহিদ ইসলাম লোকজনকে অতিষ্ঠ করে ফেলছে তিতুমীরের শিক্ষার্থীরা-স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

বিনিয়োগে দুশ্চিন্তায় ব্যবসায়ীরা

  • আপলোড সময় : ০২-০২-২০২৫ ০৬:৩৬:২৭ অপরাহ্ন
  • আপডেট সময় : ০২-০২-২০২৫ ০৬:৪৯:৩৫ অপরাহ্ন
বিনিয়োগে দুশ্চিন্তায় ব্যবসায়ীরা
* গত ছয় মাসে রাজস্ব ঘাটতি ৫৮ হাজার কোটি টাকা
* ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে বহুমুখী সংকট
* অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে বিদেশি বিনিয়োগ সর্বনিম্ন
* দেশে আয় কমে যাওয়ায় ব্যয় কমানোর পরিকল্পনা


বাংলাদেশে অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচক খারাপ হওয়ায় ব্যবসা ও বিনিয়োগে দুশ্চিন্তায় ব্যবসায়ীরা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরকারের রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা। আয় কমে যাওয়ায় ব্যয় কমানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার প্রায় পাঁচ অর্থবছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে কম। পাশাপাশি ব্যাংকের উচ্চ সুদহারের কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ যেমন কমেছে, তেমনি অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে বিদেশি বিনিয়োগ গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে। বিনিয়োগ কমায় মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানিও কমেছে। অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও একটা নেতিবাচক ধারা দেখা যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতির জন্য এগুলোকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী সবাই।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর একদিকে যেমন বেশকিছু শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়েছে, আবার সম্ভাবনাময় অনেক শিল্প-কারখানাও অর্থাভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। আবার অর্থায়ন সংকট, ঋণ সহায়তা, সুদহার বৃদ্ধির কারণে ব্যবসায়ীরা উদ্বেগ জানাচ্ছেন নিয়মিত। সার্বিকভাবে ব্যবসা ও বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়েও দুশ্চিন্তা ফুটে উঠছে ব্যবসায়ীদের কথায়। অতীত সংকট আর বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি মিলিয়ে বাংলাদেশে ব্যবসা বিনিয়োগে যে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে সর্বস্তরের ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চলমান সংকট সমাধানে সময় লাগবে। কর্মসংস্থান, মূল্যস্ফীতি, প্রবৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সূচক খারাপের দিকে থাকায় ঢালাওভাবে কারখানা বন্ধ এবং শ্রমিক ছাঁটাই যাতে না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে পদক্ষেপ নিতে হবে। অনেক কারখানা আছে নামকাওয়াস্তে চলছিল। সবই সরকারের টাকায় চলছিল। আবার কিছু কারখানা ভালো চলছিল, যেগুলো ভালো এক্সপোর্ট অরিয়েন্টেড। কিন্তু খেলাপি ঋণ রয়েছে, সেটাকে কীভাবে রিস্ট্রাকচার করা যায় সেটাকে কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং যেসমস্ত ব্যাংকে থেকে তাদের লেনদেন আছে তাদেরকে চিন্তাভাবনা করতে হবে। সব ঢালাওভাবে বন্ধ করা যাবে না। যাচাই বাছাই করতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই চাপে ছিল সামগ্রিক অর্থনীতি। এ কারণে অর্থবছরের শুরু থেকেই রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি তৈরি হয়। এর মধ্যে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঘিরে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়লে সেই চাপ আরও বাড়ে। এতে অর্থবছরের প্রথমার্ধ অর্থাৎ ডিসেম্বরের শেষে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকায়। এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যবসা-বাণিজ্য শ্লথগতির কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৮১ শতাংশে নেমেছে। ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্র (এলসি) খোলার জটিলতায় কমেছে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি, যার প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে। এই চাপের মধ্যেও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণ করতে গিয়ে শতাধিক পণ্যে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পরে সমালোচনার মুখে ৯টি পণ্য ও সেবার বিপরীতে শুল্ক-কর কমালেও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বাড়বে বলেই আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের, যা মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়াবে।
অপর একটি সূত্র জানায়, ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে আসায় ঋণখেলাপি বেড়েই চলছে। এরই মধ্যে খেলাপি ৭৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আর ডলার সংকট কাটাতে উন্নত বিশ্বের মতো ডলারের দাম পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে আইএমএফের চাপ রয়েছে। যদিও দেশের অর্থনীতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এই শর্তে এখনো রাজি নয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন করে খেলাপি ঋণ পুনঃতপশিল সংক্রান্ত নীতিমালা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে ৫০ কোটি টাকার বেশি ঋণের ক্ষেত্রে আগে যেখানে ৬ মাসের মধ্যে কিস্তি না দিলে তা মন্দ ঋণ হিসেবে বিবেচিত হতো, সেখানে নতুন নিয়মে তিন মাসের মধ্যে কিস্তি শোধ না করলে এই ঋণকে মন্দ ঋণ হিসেবে বিবেচনা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেশের অর্থনীতিকে উন্নত বিশ্বের মতো বিবেচনায় নিয়ে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। এতে ব্যাংক ঋণের সুদহার ১৬ শতাংশ পেরিয়ে গেছে। বিপরীতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ তলানিতে ঠেকেছে। প্রায় ১৩-১৪ শতাংশে থাকা বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ গিয়ে ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশে নেমেছে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে যাওয়ার মানে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমে যাওয়া। দেশের অর্থনীতির সিংহভাগ বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীল। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে যাওয়া মানে ব্যবসায় স্থবিরতা নেমে এসেছে বলেও মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। আর এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে দেশীয় বিনিয়োগে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাস জুলাই-নভেম্বরে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৬ শতাংশ কমেছে। একইভাবে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে প্রায় ২২ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দেশে নিট সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ গত অর্থবছরের একই প্রান্তিকের তুলনায় প্রায় ৭১ শতাংশ কমেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বিদেশ থেকে সরাসরি বিনিয়োগ আসে ৯৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার। আর এ সময় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ৮৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার নিয়ে গেছেন। তাতে নিট বিনিয়োগ দাঁড়ায় ১০ কোটি ৪০ লাখ ডলারে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বিদেশ থেকে সরাসরি বিনিয়োগ এসেছিল ৯০ কোটি ৭০ লাখ ডলার। সেই সময়ে আগের বিনিয়োগের অর্থ পরিশোধ হয় ৫৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার। সে হিসাবে তখন নিট বিনিয়োগ দাঁড়ায় প্রায় ৩৬ কোটি ডলারে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ২৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা ৭১ শতাংশ। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে এপ্রিল থেকে জুন সময়ে নিট বিনিয়োগ ছিল ২৭ কোটি ২২ লাখ ডলার। সে সময় ১০৮ কোটি ডলার দেশে এলেও আগের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পরিশোধ হয় ৮১ কোটি ১০ লাখ ডলার। সেই হিসাবে আগের প্রান্তিকের চেয়ে চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে নিট বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৬১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। দেশে যে বিনিয়োগ কমছে তা দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্যেও।
বিডার তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ১ হাজার ৮৩টি ব্যবসা প্রকল্পের জন্য ১ হাজার ৩৩৪ কোটি ৫১ লাখ ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব নিবন্ধন হয়। পরের বছর ১ হাজার ৮১টি ব্যবসা প্রকল্প নিবন্ধনের মাধ্যমে ১ হাজার ২৮৮ কোটি ৩৫ লাখ ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব আসে। ২০২৩ সালে আরও কমে ব্যবসার ৯৯৮টি প্রকল্পের বিপরীতে ৮৯৭ কোটি ৮৫ লাখ ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব নিবন্ধন হয়। আর ২০২৪ সালে ব্যবসার ৭৪২টি প্রকল্পের জন্য ১ হাজার ১৬৩ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব নিবন্ধন হয়।
সূত্র জানায়, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যবসা-বাণিজ্য শ্লথগতির কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৮১ শতাংশে নেমেছে। এর আগের বছরের একই প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের জিডিপির তথ্য প্রকাশ করেছে। বিবিএসের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গত জানুয়ারি মাস থেকে টানা তিন প্রান্তিক ধরেই জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমেছে। কৃষি, শিল্প ও সেবা এই তিন খাতের উপাত্ত নিয়ে জিডিপি প্রকাশ করা হয়। গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে কৃষি খাতে। এই খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র দশমিক ১৬ শতাংশ। এর মানে কৃষি খাতে নামমাত্র প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অন্যদিকে সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ। আর প্রথম প্রান্তিকে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ১৩ শতাংশ।
সূত্র আরও জানায়, আইএমএফের শর্তপূরণ করতে ব্যবসায়ী থেকে করে সাধারণ ভোক্তা সবার ওপর শুল্ক-করের বোঝা বাড়ানো হয়েছে। বছরের মাঝপথে কর বাড়ানোয় ব্যবসায়ী থেকে ভোক্তা সবাই ক্ষুব্ধ। শুল্ক-কর বাড়ানোর সিদ্ধান্তে এরই মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে গেছে, যা সাধারণ মানুষের ওপর চাপ তৈরি করেছে। এ ছাড়া বেভারেজ থেকে শুরু করে ফল ও বিস্কুট-রুটিতে করারোপ করায় খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার হুমকি-ধমকি দিয়ে কর আদায় করতে চায়। ব্যবসার খরচ বেড়ে গেলে ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠবে। আর আইএমএফকে খুশি করতে হুটহাট সরকারের নীতি পরিবর্তনে ব্যবসায় ধস নেমে আসবে।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলে চামড়া ও পাট শিল্পের একজন উদ্যোক্তা মো. ফিরোজ আহমেদ জানান, অতীত ও বর্তমান সংকট মিলিয়ে রফতানিমুখী দুটি শিল্প কারখানাই এখন রুগ্ন। পাটকলে সক্ষমতার ২৫ শতাংশ এবং চামড়া কারখানায় দশ ভাগের কম সক্ষমতা কাজে লাগাতে পারছেন। ফিরোজ আহমেদের দুই কারখানার ৮০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ জমেছে। দৈনিক সুদ হচ্ছে ৩০ লাখ টাকা। চামড়া ও পাটকল মিলে আড়াই হাজারের বেশি শ্রমিকের কাজ নেই। তার দাবি, দেশে পাট ও চামড়া কাঁচামালের অভাব নেই। বিদেশি ক্রেতা ও রফতানির সুযোগও রয়েছে। পুরোদমে কারখানা দুটি চালাতে তার এখন ন্যূনতম ২০০ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দরকার। এরই মধ্যে সুদের হার বৃদ্ধির কারণে ঋণের সুদ আরও বেড়েছে। আমাদের দুটো ফ্যাক্টরিতে দৈনিক মাত্র ৫-৭ লাখ টাকা ইনকাম হয়। এখন এতবড় ইন্টারেস্ট কী করে দেব? এই জায়গাগুলো এই সরকারকে দেখতে হবে। এশিয়ার মধ্যে বড় ফ্যাক্টরি তৈরি করেছি, যদি ব্যাংক এগুলো না দেখে আমার মনে হয় এই বাংলাদেশে নতুন করে কোনো লোক এই ধরনের রিস্ক নিয়ে নতুন করে আর ব্যবসা করবে না। ফিরোজ আহমেদ বলেন, ২০১৭ সালে স্থাপিত সুপারেক্স লেদার কারখানায় দৈনিক এক লাখ বর্গফুট চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে সক্ষম। তার দাবি এশিয়ার বৃহত্তম এ কারখানাটি দেশের মাত্র তিনটি পরিবেশবান্ধব (এলডব্লিউজি) সনদপ্রাপ্ত চামড়া কারখানার একটি। চামড়া কারখানায় বিনিয়োগ করে পাটকলের মূলধনেও ক্ষতি হয়েছে। দেশের একটি বেসরকারি ব্যাংক প্রতিশ্রুতি দিলেও সময়মতো এবং প্রয়োজনীয় ঋণ না দেয়ায় গভীর সংকটে পড়তে হয়, জানান তিনি। কারখানা দুটি চালাতে না পারলে ফিরোজ আহমেদের ঋণখেলাপি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফিরোজের অভিযোগ, অতীতে ব্যাংক ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে গড়িমসি করেছে। একটি ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনের পর প্রতিশ্রুত ঋণ পাননি বলেই সমস্যা বেড়েছে। শতভাগ দেশীয় কাঁচামাল নির্ভর রফতানিমুখী শিল্প ঋণ সহায়তা পাবেন এমন আশাবাদ তৈরি হয় সরকার পরিবর্তনের পর। কিন্তু ফিরোজ আহমেদ বলছেন, পরিস্থিতি আশানুরূপ পরিবর্তন হয়নি। ফিরোজ আহমেদের মতো বহু ব্যবসায়ী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান-শিল্পকারখানা চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো জানাচ্ছে।
প্রাণ আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহসান খান চৌধুরী বলেন, ব্যবসায়ীদের অবস্থা ভীষণ খারাপ। তাদের লোনের টাকা শোধ করতে বেগ পেতে হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা নিজেদের ব্যয় নিয়ে কষ্টের মধ্যে আছেন। বিদেশি ক্রেতারা আরো স্বল্পমূল্যে পণ্য ক্রয় করতে চাচ্ছেন। ভারতীয় কম্পিটিশন আসতেছে গার্মেন্টস সেক্টরে। সো অভারঅল ব্যবসায়ীরা কিন্তু বিভিন্নমুখী চাপের সম্মুখীন হচ্ছেন, এটা কিন্তু কেউ ডিনাই করতে পারবে না।
বাংলাদেশে অন্যতম বড় শিল্পগ্রুপ প্রাণ-আরএফএলের কর্ণধার বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র শঙ্কিত নয় প্রাণ আরএফএল গ্রুপ। যদিও দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগের পরিস্থিতি কয়েক বছর ধরে একটা স্থিতাবস্থার মধ্যে ছিল। এখন বিনিয়োগে একটা ভাটা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে গত অর্থবছরের তুলনায় ৭১ শতাংশ কম।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ঘুষ দুর্নীতি এগুলো কিন্তু কমে নাই। ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ জিডিপির ২৩.৫ শতাংশ এবং বিদেশি বিনিয়োগ সেটা জিডিপির এক শতাংশের নিচে ছিল। সেটা কমে কমে ০.৩ এর কাছাকাছি রয়েছে। একটা বড় সময় ধরে বাংলাদেশে বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা কোনো সময়ই সারা পৃথিবীতেই কোনো জায়গায় বিনিয়োগ করতে চাইবে না যদি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা থাকে। এবং অনেকেরই আমাদের সাথে তো কথাবার্তা হয়, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের। তারা বলেছে যে ইলেকশনের আগে তারা নতুন বিনিয়োগ করার কথা ভাবছে না। এটা দুশ্চিন্তার কারণ। বিনিয়োগের মাধ্যমেই তো কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। ফাহমিদা খাতুন বলেন, ঘুষ-দুর্নীতি এগুলো কিন্তু কমে নাই। ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে সিপিডির জরিপে ১৭টি সমস্যা সামনে এসেছে, এর মধ্যে দুর্নীতি এক নম্বর। ব্যবসায়ীরা বলতে পারছে না সরাসরি কারণ। ধরেন ব্যবসা যারা করেন, সেনসিটিভিটির মধ্যে থাকেন, তারা ভয়ের মধ্যে থাকেন যে কী বলতে কী বলে ফেলি। আবার ব্যবসার ক্ষতি হয় কিনা। আবার এখন তো দেখা যাচ্ছে আমরা অন্য ধরনের স্বাধীন অবস্থার মধ্যে রয়েছি যে কোনো একটা বক্তব্য পছন্দ হলো না, একটা মব জাস্টিসের মধ্যে পড়ে যায় অনেকে। তারা তো ওইরকম রিস্কের মধ্যে যেতে চায় না। যদি ভাঙচুর হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে তাদের ব্যবসা তো বন্ধ হবে। পরিস্থিতি খারাপ হবে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়াম্যান ও এফবিসিসিআইএর সাবেক সভাপতি এবং বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, যে পরিবেশ-পরিস্থিতিতে একটা দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে, বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায় এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় সেটা অনুপস্থিত। দেশি বিনিয়োগকারীকে যখন দেখবে যে এরা বিনিয়োগ করতেছে তখন আস্তে আস্তে আসবে। না হয় বিদেশি যেগুলো আছে এগুলো কেমনে চলে যাবে সেই চিন্তা করবে। আমি যদি আমার দেশে বিনিয়োগ না করি তো বিদেশি কি মরতে আসবে এখানে? ওতো আমাদের থেকে বেশি চালাক। সে পরিসংখ্যান আমার থেকে বেশি বোঝে। সে দেশের রাজনীতির অবস্থা বেশি দেখতেছে। আমরাতো এখানে ভেতরে বসে অনেক কিছু বুঝি না, কিন্তু তারা বেশি বোঝে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি তলানিতে নেমেছে, রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা যাচ্ছে না। এককথায় বললে অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা খুবই নাজুক। রেমিট্যান্স, রফতানি আয় ও রিজার্ভ ছাড়া অর্থনীতির সবকটি সূচক নেতিবাচক অবস্থায় রয়েছে। এ ছাড়া বিদেশে জনশক্তি রফতানিও কমেছে।
 

নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

কমেন্ট বক্স